নক্ষত্রে গোধূলি-৫৮/২৫০

৭৭।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে ফোন ধরলেন।
-হ্যালো
ওপাশ থেকে মেঝো ভাইয়ের কণ্ঠ-
-সালামালেকুম, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ চলছে একরকম।
-কাজকর্ম কেমন?
-খুব কষ্ট, জীবনে অনেক কষ্টের কাজ করেছি কিন্তু এই কষ্ট তার কাছে কিছুই না। এখন বয়সও হয়েছে পারছি না। যা আছে তাও যদি একটু ধীরে সুস্থে হোত করা যেত, তাহলে চলতো কিন্তু সবাই চায় বলার আগেই যেন রেডি হয়। কিচেনের সবাই অর্ডার করে তার মধ্যে মালিক হলো তিন জন। একজন সেফ অন্য দুজন সামনে। সামনে থেকে এসে ওয়েটাররাও এটা ওটা করতে বলে। সবারই এক কথা ‘কুইক। তখন বিশ্রী ভাবে আজেবাজে কথা বলে। কাজ যেমন তেমন কথাগুলিই বেশি কষ্টের। কেও সহজ করে কথা বলে না, সাধারণ কথা গুলিই বাঁকা করে বলবে অশ্লীল ভাবে। এদিকে হাত কেটে কুটে অবস্থা খারাপ।
-হ্যাঁ, এটাই এদের স্বভাব। ওখানে গ্লোভস নেই?
-না গ্লোভস দেখি না।
-বলবেন গ্লোভসের কথা।
-হ্যাঁ, ফিরোজও বলেছে বলতে, বলা হয়নি। ভয় করে আবার কী বলে না বলে তাই আর বলিনি।
-এমনি অন্য সময় কথাবার্তা আচার ব্যাবহার কেমন, গালাগালি করে?
-এমনি অন্য সময় যা তা মেনে নেয়া যায় তবে শুনেছি বিজির সময় সেফ নাকি গালাগালি করে। আমি যেদিন এসেছি সেই শুক্র শনিবার সেফ ছিলো না তাই দেখিনি কেমন, এখনও দেখছি ভালোই।
-আচ্ছা চলুক এভাবে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে আর বিশেষ করে আপনি অনেকদিন শুধু অর্ডার করেই এসেছেন এধরনের কাজের সাথে তো আপনার পরিচয় নেই, সামনে কাজ পেলেন না, না?
-না, পেলাম না অবশ্য খুঁজতেও পারিনি তেমন করে। প্রথমেই যা পেয়েছি তাতেই চলে এসেছি। সামনের একটা কাজ পেয়েছিলাম কিন্তু সেটা আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে। ফিরোজ ওখানে যেতে নিষেধ করলো বললো অত দূরে গিয়ে দরকার নেই এদিকে আসা যাওয়াতে অসুবিধা হবে তুমি মেইন ল্যান্ডেই থাকো। তাই আর গেলাম না। ও হ্যাঁ, ব্রিস্টলেও একটা পেয়েছিলাম কিন্তু বেতন কম। এখন মনে হচ্ছে ওখানে গেলেই ভালো হোত। বেতন কম বলে ফিরোজ ওখানেও নিষেধ করেছে।
-আচ্ছা যাই হোক, আপাতত একটা দাঁড়াবার জায়গা তো হয়েছে পরে সুযোগ মত খুঁজে নিতে হবে। কিচেনের কাজ আপনি পারবেন না। আমি জানি এখানকার এসব কাজ হলো অল্প বয়সীদের জন্যে। দেখা যাক কিছু দিন থাকেন এভাবে। কাল ঈদ জানেন?
-হ্যাঁ, এইমাত্র শুনলাম।
-নামাজ কোথায় পড়বেন, কিছু শুনেছেন?
-না তেমন আলাপ হয়নি শুধু জানলাম যে সবাই লন্ডন অক্সফোর্ড চলে যাবে, মাত্র একজন থাকবে এখানে। কোথায় মসজিদ কিছু জানি না, শুনিনি এখনও।
-আমরা লন্ডন যাবো।
-কোথায়, কখন?
-ওর বোনের বাসায়, সকালেই যাব। সাথে কাজলও যাবে।
-ও আচ্ছা।
ভাইয়ের কথা শুনে রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবছিলেন হয়ত বলবে যাবার সময় আপনাকে নিয়ে যাব। এই কথা বলার জন্যেই হয়তো ফোন করেছে কিন্তু সেরকম কিছু শোনার আগেই ওপাশ থেকে বললো –
-তো ঠিক আছে তাহলে রাখি, কি আর করবেন কষ্ট করতে এসেছেন আর একটু করেন। সামনের কাজে এতো কষ্ট না। পেলে চলে যাবেন, আচ্ছা সালামালেকুম।

খট করে লাইন কাটার শব্দ পেয়েও রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন আরও কিছু শোনার আশায়। না, ওপাশ থেকে আর কোন কথা এলো না। রিসিভার নামিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিনের সেই কথা মনে হলো। মনি বলে গেছে দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে। ভুলতে চেয়েছিলো আবার কেন এই আঘাত? ওরা লন্ডন যেয়ে ঈদ করবে এই খবর শোনার জন্যে কি সে অস্থির হয়েছিলো, না কি এটা ওর জানা খুব জরুরি? তাহলে কেন, কেন আবার মনে করিয়ে দেয়া? ওখানে যা হয়েছে তা কি যথেষ্ট নয়? সেই ক্ষত সেরে উঠার মত সময় কি সে সারা জীবনে পাবে? তার পরেও আবার কেন? এ কি শুরু হলো তার জীবনে, কোন খেলা এটা? সেতো কখনো কারো সাথে এমন করেনি! কারো মনে আঘাত দেয়া তো দুরের কথা কারো সাথে উঁচু স্বরে কথাও বলেনি। কারো অমঙ্গল চিন্তা করতে পারে না সে, তার মনই সে ধাঁচে গড়া নয়, এসব তার ভাবনায়ই আসে না। এ কোন পরীক্ষায় পড়েছে, কি ভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসবে?
মনে আছে ছোট বেলায় তার এক মামা তার এই নরম স্বভাব আর কোমল মন দেখে আফসোস করে বলেছিলো তোকে তো বড় কঠিন ভাবে জীবন পাড় করতে হবেরে ব্যাটা। এই কঠিন দুনিয়াতে এতো নরম হলে কি চলে? এদিকে আয় তোকে শক্ত হবার ট্রেনিং দেই আয়। এক কাজ কর ওই যে একটা ছেলে দেখছিস ওকে একটা ধমক দিতে পারবি? যদি তোর ধমক শুনে ও ভয় পায় তাহলে এক আনা পাবি।
-না মামা আমি পারব না।
-আরে যা না দিয়েই দেখ পারবি, পারবি যা।
ধমক দিয়েছিলো কিন্তু ওই এক আনা পাবার মত হয়নি। কোথাও মারামারি দেখলেই তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করত। দৌড়ে বাসায় এসে মায়ের আঁচলের তলায় লুকাতো। তার হাঁপানি দেখে মা বুঝতেন কোথাও কিছু হয়েছে আর বকতেন এমন ছেলে কি করে চলবে এই দুনিয়াতে! সেই রাশেদ সাহেবের জীবনে এসব কি ঘটছে, কী, হচ্ছে কি এসব? আমি কী করেছি? কী করেছি? ভাবতে ভাবতে রুমে এসে জ্যাকেটটা খুলে হুকে ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় বসলেন। কতক্ষণ বসে ছিলেন মনে নেই। ভিড় কম বলে আজ একটু তাড়াতাড়িই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে সবাই যার যার উৎসবে মেতে উঠার আনন্দে বাড়ির দিকে ছুটে যাবার পথে বের হয়ে গেলো। নুরু এলো রুমে।
-কি ভাই, কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি?
-কাছে এসে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার বললো ।
-আরে কাল ঈদ আর আপনি এখন মন খারাপ করে অন্ধকারে এভাবে বসে আছেন কেন? ও! বাড়ির কথা মনে পরছে? না না ভাববেন না এতো ভাবার কি আছে? বিদেশে এতো মন খারাপ করে থাকবেন না এখানে তো আর কেও নেই যে এসে দেখবে। উঠেন যান খেয়ে দেয়ে এসে নিচে কবিরের সাথে টিভি দেখেন বসে। আমি চললাম, ঈদ মোবারক।
নুরু চলে গেলো। রাশেদ সাহেব একটা সিগারেট বানালেন। হাত দুইটাই টেবিলের উপরে এক হাতে সিগারেটটা ধরা। কবির এলো রুমে।
-কি খবর নয়া ভাইসাব একলা কি করেন খাবেন না আজতো সেহেরি নাই আসেন খেয়ে আসি।
রাশেদ সাহেবের মুখে কথা নেই। কবির পাশে বসলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো –
-কি ব্যাপার ভাই মন খারাপ?
-না এমনিই।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো –
-তামাক খাবেন?
-আমি বানাতে পারি না।
-নেন আমি দেখিয়ে দেই।
-কি তামাক এটা?
-এরিনমোর।
-বেশ ভালো, একটু কড়া তবে গন্ধটা সুন্দর, এটা কি এখান থেকে নিয়েছেন?
-না দেশ থেকে এনেছি, এখনও এখান থেকে কেনার দরকার হয়নি, আরও কিছুদিন চলবে।
তামাকের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নিচে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে উপরে এসে কবির বললো –
-চলেন টিভি দেখি
-না ভাই আমার ভালো লাগছে না আমি শুয়ে পরবো আপনি দেখেন। আচ্ছা ভালো কথা কাল ঈদের নামাজ, কোথায়, কখন যাবেন?
-হ্যাঁ, যাবো। সকালে নয়টায় বের হয়ে অক্সফোর্ডে যেতে হবে, জামাত হবে দশটায়।
-তাহলে আমাকে নিয়ে যাবেন।
-হ্যাঁ, আমি আর আপনেই যাব। তাহলে এই কথাই রইলো আমি চলি এখন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৯-১২-২০১৯ | ৮:৪৯ |

    শুভেচ্ছা প্রিয় বন্ধু। শুভ সকাল। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...